১৮. বিদেহী আত্মা
রাত হলে বাড়ি ফিরি বলে আমার দিকে হেলে পড়েছে ঘরের দেয়াল। তার নির্বিকার চাহনিতে আমি দগ্ধ হই নিয়ত। মনে হয় কে জানি ইঁদুরচোখে দেখছে আমায়। জানোই তো, ইদুরে আমার ভীষণ অপছন্দ সেই আদিকাল থেকে। শুনেছি জন্মাবার পর থেকেই। বিশ্বাস করো, ইঁদুরবিদ্বেষি আমি ছিলাম সেই সৃষ্টির আদি থেকে আমাদের আত্মারা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থেকেছিলো কোনো না কোনো দেহ পাবার আশায়!
আমি ছিলাম আত্মা ছাড়া এক। শুধু শুধু দেহ নিয়ে আচানকলয়ে ঘুরছিলাম। তারপর মাঝপথে এসে কোন এক আত্মাকে বগলদাবা করে নিজেকে দিয়েছিলাম মানুষে অবয়ব! তাই পৃথিবীপথে আসতে গিয়ে হাওয়ায় ভাসা সবগুলো প্রশ্নকে উড়িয়েছিলাম নির্বিকার। ভাবনায় আমি ছাড়া ছিলনা কেউ বলে শুধাতে পারিনি আত্মার পেছনকার মালিকের নাম। তাই কিছুদিন থেকেছিলাম পরিচয়হীন!
ইত্যবসরে শোনা গেলো কোন এক বিদেহি আত্মাচরিত্র চুরি গেছে। যার নাম ছিল কবিদের কাতারের ঠিক সামনে। আমি আমাকে লুকাই, আমার আত্মাকে লুকাই কিন্তু দেহ লুকাতে গিয়ে ধরা পড়ি নিজের কাছে। চুরি করা মন চুপি চুপি চুপ হয়। নিজেকে আবিস্কারের কালে আবিস্কার করি কলম্বসের সহোদর।
আমার ঘরের বারান্দায় আজ আমি একটা ছবি লটকে রাখতে চাই; ঠিক ঠিক আমিপ্রতিরূপ। ঘরে ঘরে আমার বাস বলে বারান্দাতেই থাক আমাপ্রতিকৃতি। আমি আমাকে দেখতে গেলে উঁকি দেবো বারান্দায়! যেখানে রাতের চাঁদ এসে সরাসরি উপচে পড়বে আমার ওপর!
আমার আত্মা আমাকে ডাকে। আমি ডাকি দেহকে। দেহ ডাকে আত্মাকে। পড়ে যাই ঘূর্ণাবর্তে। ঘূর্ণনের কালে ঘূর্ণি উঠে সময়ে বিদেহী আত্মা আবারো দেহ খুঁজে নির্লিপ্ততাকে সাথে করে।
১৯. রাতের আকাশ
মাঝে মাঝে ভাবতে যাই একদিন যখন টুপ করে মারা যাবো সেদিন প্রথম দেখাতেই যার সাথেই পরিচিত হবো তাকে শুধাবো কী করে রাতের আকাশ হওয়া যায়। তারপর রাতভর পাহারা দেবো পূরো পৃথিবী। নিশাচর কিছু পাখিকে সাথে রেখে পাহারা দেবো আর বাকি সবার উদ্দেশে রাতভর শুনাবো রাতের গান।
রাত আমার পছন্দের খুব। রাতের আকাশ তার চে'ও! কী নির্ভার সম্মোহন দৃষ্টি। আকন্ঠ ভালোলাগার ছোঁয়া। তারাদের সাথে রাতভর তারাময় খেলা। সে খেলার হার-জিত উহ্য রেখে নিত্যরাত সে একই সূঁতো ধরে পাড়ি দেয়া হবে আর অনেকটা পথ। যে যাবে সে যাবে সাথে। সে-ই থাকবে যে কোন একদিন পথিক হয়েছিল-রাতের পথিক!
যে রাত কোন একদিন আমাকে আহবান জানিয়েছিল তার পথ ধরে হাঁটার। আমি কৃতজ্ঞচিত্তে তার কাছে পাঠিয়েছি এক উড়ো চিঠি; সইসহ। আমার নামধরে উচ্চস্বরে ডাকবে বলে চিঠির নিচে সেটে দিয়েছি বৃত্তান্ত। আমি বসে আছি তার ডাক শুণবো বলে। এভাবে কেটে গেছে কতদিন, কেটে যায় কতদিন কিন্তু তার ডাক কানে আসেনি অদ্যাবধি!
আজ কতদিন হয় আয়নার সাথে আমার দ্বৈরথ চলে। জয়-পরাজয়ের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম হিসেব ভুলে ফি রাত রাতের কাছে সমর্পণ করি নিজেকে। প্রত্যুত্তর হেলায় আয়নার কাছে ফিরি। আয়নাও বলে না কিছু। আমাকে একা রেখে আর সবাইকে দেখিয়ে চলে আপনার অবয়ব!
তবে জানি আমাকে ফেরাতে পারেনা রাতের আকাশ! তাই কোন একদিন আমিও আকাশ হবো-রাতের আকাশ। যার বুকে গোটা গোটা হরফে কোন এক নাম লিখা হয়ে থাকবে, কবির-ই সে জন; কবির য়াহমদ।
২০. আবরণ
আবরণেও আছে ঢের হিসাব-নিকাশ। তাই একটা পাখিকে ডানাসহ ওড়িয়ে দিয়েছিলাম আকাশে। পাখিটা আকাঙ্ক্ষার আকাশ পেয়েছিল বলে পেছনে তাকায়নি পাছে কেউ হাতে ধরিয়ে দেয় মখমল পালক। ফলত কিছু আকাঙ্ক্ষিত চোখ শূন্যে তাকিয়ে দেখে বৃহৎ থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে মিলিয়ে যাওয়া কোন পাখি।
কেউ কি জেনেছিল আগে পাখিরাও নগ্ন হয়! মিলিয়ে যাবার ক্ষণে আবরণহীন হয়ে নিজেকে খুঁজে নেয় সমূহ ওমে। জন্মনিয়ন্ত্রণের ছলাকলা নিয়ে কেউ সামনে এলে মূহুর্তে ভুলে যেতে বসে প্রাত্যহিক ধারাপাত। কাঁচের শার্শিতে ঝরে পড়ে জল প্রতিবেশিদের নাকের ঢগা দিয়ে। একবার, দুইবার করে কতবার তাঁর হিসেব রাখেনা আর কেউ; এমনকি পাখিরাও।
একটা হাইরাইজ উদ্দামতা পাখিদের গতরে ভর করে আচমকা। একটা অকালপক্ক গতর ধরে শীতল হাওয়া বয়ে যায় একনাগাড়ে। পাখি জানেনা শুরু থেকে অথচ মাঝপথে হঠাতই নিজেকে বিলিয়ে দেয় প্রাগৈতিহাসিকতায়।
পাখিদের গতরে জন্ম নিতে থাকে আরেক পা।
২১. পরী
সব ঠিক ছিল শুধু ছিল না তোমার বেণী করার ধরণ
তাই আলগোছে কিছু চুল বাঁধিয়ে দিয়ে যেত সমূহ জঞ্জাল
একদিন যদি ভাল করে জেনে যেতে বেণীর ছলাকলা
তবে চুলগুলো বেঁধে রাখতে নিজের করে; সে উড়তে জানতো না আর
অথচ জেনে রেখো এখানের কিছু নিমগ্ন দর্শক চায়নি কভু
তুমিও জেনে যাও গায়ের আলতা মেয়ের বেণী করে বেঁধে রাখা চুল!
দোহাই তোমার, যেভাবে আছো সেভাবেই থাকো
তোমাকে হতে হবেনা আর আলতা মেয়ে কিংবা বেণীওয়ালা পরী!
২২. আকাশ
যাকে বলে ইতিহাস তার কাছ থেকে কেউ কী আর শিক্ষা নিতে জানে
তবু ইতিহাস তার মতো করে বয়ে চলে ক্রমশঃ
আমাদের কালে যাকে তুমি অবলীলায় ধরাকে সরা জ্ঞানে দূরে ঠেলে দিচ্ছো
ভাঙা গলায় যে মিথ্যাকে সত্য বলে ফলাও করে যাচ্ছো নিয়ত
মনে রেখো একদিন আর সবার কাছ থেকে আমিও খুলো দেবো দখিনা দ্বার
সে সময়ে এক পশলা মিষ্টি হাওয়ায় আমিও জড়িয়ে নেবো আমার আমিত্বকে
যদিও হয়ে যাবো দূরের পাখি, দূর আকাশে নয় কাছের আকাশের, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয়া আকাশের।
এ আকাশ আমার একান্ত আকাশ, এখানে উৎপত্তি হয়না কোন ঝড়ের
এখানে জড়িয়ে থাকে কিছু ভালোবাসা; একান্তই ভালোবাসা!
২৩. জানে অবনত পাতারা
অবনত পাতারা জানে শৃঙ্খলিত গ্রামের মাটি
অবনত পাতারা জানে উল্লসিত রতিক্রিয়া।
বর্ষণ শেষে নিরুত্তাপ ভূধারায় নামছে এক কঠোর বাষ্প
ঊর্ধ্বপানে তাকিয়ে থাকে কালের মশাল
তারা উপলব্ধির দরোজায় টোকা মারে
শিক্ষিতজনের শীতলস্নেহে জড়িয়ে নেয় কালের ওম,
তাদের কথা আলাদা যারা আলাদা ভেবেছে নিজেদের
অবজ্ঞায় উপলব্ধি করেছে কিছু স্বর্গীয় গৌরব।
আমাদের কল্পউৎসবে হাজির হয়েছিল কিছু সমার্থক শব্দ
বৃষ্টিদিনে তাদের ঈশারায় দেখিয়েছি মেঘদল
আবারো অবনত পাতা আবারো রমণক্রিয়া
আমাকে দেখায়, আমাকে শেখায় জন্মরহস্য।
রায়নগর ২৪ অগাস্ট ২০১২।
24. ঈশ্বর জন্ম
তথাপি ঈশ্বরজন্ম
তথাপি বাহুল্যজ্ঞান
কেউ কেউ তুলে নিয়ে আসে পাতালের ঘ্রাণ।
মেঘজন্মে দেবদূত, সম্ভোগে দৈবপাত এ খেলা চলে
কিম্ভূত ছলাকলায় দৈব ডাক,
ঈশ্বরজন্ম আহা-
আজীবন থেকে গেলে অপ্রমাণের ছলে।