দিলকুশা টু গেন্ডারিয়াঃ একটা গল্পের প্লটের খুঁজে

 

খুব সকালে অফিস যেতে যেতে আতংকে থাকি রাস্তার জ্যাম আর ধুলোবালিতে। এ এক নিত্যকার তাই সকালের সজীবতাটুকু বলি দিয়ে যাই ধুলোর কাছে। রিক্সাওয়ালাদের কাছে নিত্যদিনের জিম্মিত্বের দশা কাটেনি সেই কবেকায় থেকে। তাই হররোজ আকুতি-মিনতির পর বেশি ভাড়াতে রিক্সা চাপি পেটের তাগিদে। পেট, পেট, অতিব গোলাকৃতিরূপী পেটের কাছে অসহায় থেকে থেকে কাটিয়েছি অনেকদিন। এভাবে চলছে, চলবেই!
 
সকাল হতেই কলিগকে বলে দিলাম এই ব্যাংকের সবগুলো মেয়েই আমার কাছে একেকটা বিরক্তির মাংসপিণ্ড। কলিগটি মেয়ে ছিল বিধায় যেন আকাশ থেকে পড়ার ভাব ধরে দুঃখিত গলায় বললো, কী করেছি আমরা? আমি বললাম, এ প্রশ্ন অমীমাংসিত, তাই উত্তর নাই। পাশে সিটে বসা এক ছেলে কলিগ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর কাষ্ঠহাসি হেসে বোবারূপী হয়ে আরো কিছু শোনার প্রতীক্ষায় থাকলো। আমি কিছু আর বলিনি। কারণ এর বেশি বলার দরকার এবং নিয়ম নাই। ইত্যবসরে মোটামোটি ভালোই চাউর হয়ে গেছে আমার এ কথাটি! পিএবিএক্সে কয়েকজনের ফোন আসলো। আমি বললাম, হ্যা, এ অফিসের মেয়েরা খুব বিরক্তির আমার কাছে মনে হয়! কয়েকজন খুব দুঃখ পেলো। তাদের দুঃখে আমি সুখী হলাম। মনে হয় এটাই নিয়ম। আচানক দুঃখে কাউকে সুখী হতে হয়!
 
দিনের অনেকটা সময় গেলো। মাঝদুপুরে একটা মেয়ে কলিগ আমার কাছে আবারো জানতে চাইলো আমি কী সকালের কথায় এখনো অনঢ় আছি? আমি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ানোতে দিনের দ্বিতীয়বারের মতো হতাশ হয়ে বললো- এখানকার সবাই আপনাকে পছন্দ করে বলেই আপনি এমন কঠিন কথা বলতে পারলেন! আমি তাকে অবাক করে দিয়ে বললাম, এটা জানি বলেই এ সুযোগে কঠিন সত্য কথাটি বলতে পেরেছি! তা না হলে পারতাম না! কলিগটি প্রশ্ন করলো, অফিসের বাইরের মেয়েদের সম্পর্কে আজকের ভাবনা কী? আমার সপ্রতিভ উত্তর, তাদের নিয়ে আমি আজ ভাবিনি তাই কোন আলাদা ভাবনা নেই! তবে মনে হয় তারা খুব বেশি বিরক্তির হবেনা!
 
লাঞ্চের সময়ে রবী এলো। দিনকার মতো কিছু বিষয় জানতে চাইলো। ওর ধারণা আমি একজন বিখ্যাত মনোবিশ্লেষক হতে পারতাম। ওর বার বার প্রশ্নের উত্তরে আমি আগেই বলেছিলাম, আমি মনোবিশ্লেষকের চাইতে সমাজবিজ্ঞানী হতে পছন্দ করেছিলাম। তাই আমার ডিগ্রি অর্জন ছিলো সমাজবিজ্ঞানে! আজও একই প্রশ্নের উত্তর আমি একইভাবে দিয়েছি। আমি আজ ওকে খুব কম সময় দিতে পেরেছি। খুব সম্ভবত পাঁচ মিনিট! ও আমার কাছে আসার আগে ফোনে অ্যাপয়েনমেন্ট নিয়ে থাকে। এটা আমি খুব উপভোগ করে থাকি। আজও করলাম। ওর আজকের প্রশ্ন ছিলো, মানুষ কখন বিভ্রান্ত হয়? আমি আমার মতোই উত্তর দিয়েছি। ও খুব সন্তুষ্ট ছিলো আমার উত্তরে রোজকারের মতো। প্রতিবার যাওয়ার সময়ে আমি বলে থাকি- আমার কথাগুলোই শেষ কথা নয়। আজও বললাম। ও বিশ্বাস করলো। আমি তাঁর বিশ্বাসের প্রসঙ্গে বলেছি, তোমার বিশ্বাসটা আমার প্রাপ্তি এই কারণে কারণ আমি তোমাকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছি!
 
অফিস থেকে বেরিয়ে রোজকার মতো রিক্সা নেবো ভেবেছিলাম। কিন্তু নিলাম না! এর কী কারণ আমি জানি না। কিছু কারণ আসলে অজানা থাকে। সেটা হ্য়তো ছিলো তেমনই এক। মতিঝিলে সন্ধ্যা সাত-আটটার দিকে রিক্সাযুদ্ধে নামতে হয়। হররোজ আমিও নামি। মাঝে মাঝে রিক্সাওয়ালাদের ভাড়া হাঁকা নিয়ে বিরক্ত হই। ত্রিশ টাকার ভাড়া ষাট টাকা হাঁকে। বিরক্ত হলে প্রায়ই বলি পাঁচ টাকায় যাবে? যদিও চল্লিশ টাকার নীচে এই কয়েক মাসে কখনো আসতে পারিনি। তাদের অবাক আর হতাশ করা ভঙ্গিমা খুব উপভোগ করে থাকি। মাঝে মাঝে এটাকে ব্রাত্যজনের প্রতিশোধ হিসেবেই নিই। আজকের সিদ্ধান্ত ছিলো পায়ে হেঁটে বাসা ফেরা। এতে অনেক লাভ! সব লাভের বড়ো লাভ অনেকগুলো টাকা বাঁচানো। এই দূমূল্যের বাজারে একসাথে অন্তত ৪০/৫০ টাকা বাঁচানো চাট্টিখানি কথা নয়।
 
হেঁটে আসা যখন তখন পথ ধরলাম আড়াআড়ি পথে যেখান দিয়ে শহরের ট্রাফিক জ্যাম অতিক্রম করে সহজেই বাসা ফেরা যায়। সফলও হলাম। রাস্তায় যেখানে প্রতিদিন ঘন্টাখানেক ঠায় বসে থাকতে হয় সেখানে হেঁটে আসলাম মাত্র পঁয়ত্রিশ মিনিটে। আড়াআড়ি পথে ঢুকলাম স্বামীবাগের রাস্তা দিয়ে। অন্ধকার পথ। ভাবছিলাম ছিনতাইকারীর কোন দেখা পাবো। কিন্তু অনেকখানি পাড়ি দেবার পরেও তাদের কোন দেখা পেলাম না। মোটামোটি হতাশ হবার জোগাড় তখন- এই দাড়া’ শব্দে সম্ভিৎ ফিরে পেলাম। রাস্তার পাশে দেখলাম তিনজন পুলিশ ভদ্রলোক। আমার ঠিক সামনের জনকে দাড়াতে বললেন। ছেলেটা দাঁড়িয়ে পড়লো। ঠিক পেছনে আমিও। এক পুলিশ মহোদয় ছেলেটার দেহ তল্লাশি করলেন। আমি অপেক্ষা করছি আমাকে কখন তল্লাশিতে যাবেন! তিনজন পুল্লিশের একজন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আমি বললাম আমাকে তল্লাশি করবেন না! পুলিশ তিনজন অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। আমাকে বললো আপনি যান! আমি হতাশ হয়ে হাঁটা ধরলাম।
 
আমি হাঁটছি, আমার সাথে হাটছে আমার দেহ; আমার মাথা। পাশ দিয়ে অনেকগুলো রিক্সা চলে যাচ্ছে। কয়েকটা রিক্সা বিরক্তিকরভাবে ঘন্টা বাজিয়ে চলছে। একবার ভাবলাম রিক্সা নীচে পড়ি! তারপর রিক্সা ধাক্কা দিয়ে আমাকে ফেলে দেবার পরে আমি তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রিক্সাওয়ালার কাছে টাকা চাইবো; চিকিৎসার টাকা! তখন আমার মনে পড়ে গেলো, যখন গ্রামে থাকতাম তখনা আমার পরিচিত এক ছেলে এভাবেই নিজের ইচ্ছায় রিক্সার সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়ার পরেই তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে দশ টাকা চেয়েছিলো। আমি আমার মানসপটে তাঁর ছবিটা দেখতে পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমিও দশ টাকা চাইবো! এই বাজারে ফাও ফাও দশ টাকা নেয়াহেত মন্দ না! আর মাত্র এক টাকা যোগ করে অন্তত দুইটা বেনসন কেনা যাবে। নিকোটিন সুখের পাশাপাশি অর্থযোগ নিশ্চয়ই খারাপ হবেনা! এভাবে ভাবতে লাগলাম। রিক্সাগুলো চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে তাদের নিজস্বতায় টুংটাং ঘন্টা বাজিয়ে। আমার ধাক্কা খাওয়া হলো না রিক্সার সাথে। এভাবেই এক সময় হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম দয়াগঞ্জ মোড়ে ।
 
দয়াগঞ্জ মোড় দিয়ে রাস্তা পেরুতে যাবো তখনই পুরো রাস্তার মাঝে এই প্রথম পড়লাম ট্রাফিক সিগন্যালে। ভেবেছিলাম মানুষকে কোন জ্যাম আটকাতে পারেনা। আমার ধারণা পাল্টে গেলো সহজেই। সামনে দয়াগঞ্জ রেলক্রসিং। শুনেছিলাম, ওখানে নাকি প্রায়ই ছিনতাই হয়। তাই প্রতিদিন রিক্সা করে ঘরে ফেরার সময়ে পা দু’টোকে যথাযথভাবে রাখি এমন কোন পরিস্থিতিতে পড়লে যাতে করে অন্তত নিজেকে বাঁচাতে একটা হলেও কষে লাথি মারতে পারি। আজ যেহেতু হেঁটে আসছি তাই পা’কে যথাযথ অবস্থানে রাখার সুযোগ নাই ভেবে মন খারাপ হয়ে গেলো! ফুটপাতে কয়েক গজ দুরত্বে বসা কয়েকটা চ্যাংড়া ছেলেকে দেখে ভাবলাম, ওরা বুঝি ছিনতাইকারী! আমি আড়চোখে তাকালাম ওদের দিকে। ওরা আমার দিকে তাকালো না। আনমনে সিগারেট ফুঁকতে লাগলো! আমি আতংক ভরা মন নিয়ে রাস্তা এগুলাম। পকেটের স্বাস্থ্যের দিকে তাকালাম। একটা মোটামোটি মানের দামী মোবাইল ফোন যা বোনের কাছ থেকে পেয়েছিলাম যার বাজারমুল্য ন্যূনতম হলে হাজার বিশেক হতে পারে! এক প্যাকেট বেনসনের অর্ধেকের বেশি আর ব্যাকপকেটের ওয়ালেটে হাজার খানেক টাকা। যাক বাবা, আজ কিছুই হলো না!
 
সারা রাস্তা জুড়ে গল্প ছিলো সাথে। ঘরে ফিরে দেখি উধাও হলো সাথে সাথেই। পেটে ক্ষিধে লেগেছে খুব করে। গল্পের প্লট বুঝি পেটে জমিয়েছে আশ্রয়! দিলকুশা থেকে গেন্ডারিয়া ২০/২৫ মিনিটের রিক্সারাস্তায় হরদিন কাটিয়ে দিই ধন্টাখানেক সময়। এবার বুঝি হাটে পায়ে হাঁটা ক্ষণের শুরু। চলুক টাকা বাঁচানো ক্ষণ সেই সাথে গল্পের প্লট খোঁজার নিবিড় সাধনা।
 
পায়ের সাথে মাথা চলুক সমান তালে। গল্পের প্লটের দেখা পেতে মনে হয় খুব বেশি দেরি নেই!
 
০৯-০৩-২০১১

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।