অণুগল্প: তিথির হাত

 

তার পছন্দ বাংলা সিনেমা আমার ইংলিশ। আমার ক্রিকেট হলে তার ফুটবল। টিভি দেখতে বসলে রিমোটের কন্ট্রোল নিয়ে কাড়াকাড়ি চলে বেশিরভাগ সময়ে আমি জিতে গেলে মুখ গুমড়ো করে বসলে আমিও ওমন ভাব করি যেন জিতে গিয়ে অপরাধ করেছি কিন্তু রিমোটের কন্ট্রোল ছাড়িনা। তারপর মান-অভিমান নিজ নিজ অবস্থানকে পোক্ত করার প্রাণান্ত প্রয়াস। এভাবে চলছে সেই কবে থেকে তার হিসেব রাখতে পারিনা। আমাদের এই বিপরিতমূখি অবস্থানের কারণে মাঝখানে আমরা কথা বলিনি অনেকদিন তবু ভালোবাসা থেকেছিল ভালোবাসার অবস্থানেই।
 
তার নাম তিথি। আমার ভালোবাসা আর গল্পের চরিত্র। তাকে নিয়ে আমি যখন স্বপ্ন দেখতে বসি তখন মাঝখানে আর আসতে পারেনি এই এতোদিনে। তার সাথে আমার যখন পরিচিয় হয়েছিল সেদিন খুব বৃষ্টি হয়েছিল। আমরা দু’জন সে বৃষ্টিজলে অফুরান ভিজেছিলাম। সব বৃষ্টি ওপর থেকে ঝরলেও সে এক আচানক কোনো। যার শুরু হয়েছিল মাঝ থেকে। যে অপরাপর চোখগুলো ব্যর্থ হয়েছিল ভিজিয়ে নিতে নিজেদের আমরা সেদিন সফল হয়েছিলাম।তাই হাটা হয়েছে অনেকটা পথ আর বাকি পথগুলো তার সমূহ পসরা নিয়ে বসে আছে আমাদের জন্যেই।
 
ক্রিকেটে তিথির প্রিয় খেলোয়াড় জেনেছিলাম আফ্রিদি। সে নিয়ে তার সাথে আমার অনেক দিন কথা বলাও বন্ধ ছিল। আমার অবোঝ মন বলেছিলো সুদর্শন আফ্রিদির কারণে ও আমাকে ইদানিং পাত্তা দিচ্ছেনা। তাই তাকে ধমকের সুরে বলেছিলাম পাকিস্থানি কোন কিছুই আমার পছন্দের না। তুমি কোনো পাকিস্থানি ক্রিকেটারকে পছন্দ করতে পারবেনা। কিন্তু ও তা মানতে রাজি ছিলনা লোটেও। তার এক কথা রাজনীতির সাথে খেলাধুলার কী সম্পর্ক? আমি বলেছিলাম খেলাধুলা যেমন মানুষের আবেগের কোন এক গহীনে বাস তেমনি করে রাজনীতিও! ও তা মানে নি। এ নিয়ে তার ফোন ধরিনি আমি পূরো এক সপ্তাহ। তারপর একদিন তার বাসায় আচমকা উপস্থিত হয়ে বলেছিলাম ঠিক আছে খেলাধুলা নিয়ে আমি সিরিয়াস কিছু বলবো না কিন্তু তোমার পছন্দের খেলোয়াড়ের তালিকা থেকে আফ্রিদিকে বাদ দিয়ে দাত উচু কামরান আকমলকে রাখতে হবে! ও কী ভেবে যে সেদিন আমার এ কথায় রাজি হয়েছিল তা এখনো রহস্যই!
 
তিথির সাথে আমার সম্পর্কের বয়স সময়ের হিসেবে মাত্র বছর তিনেক। কিন্তু আমি ভাবি আমাদের এ সম্পর্কের শুরু হয়েছিল সেই আদিকাল থেকেই যখন আমরা নিজেদের পরিচয়টা পর্যন্ত পাইনি। আমি অবাক হই ও ভাবছে তেমন করে। কেন এমন হয় আমি বুঝতে পারিনা। আমরা মনের দিক থেকে এতো কাছাকাছি পর্যায়ের থাকলেও পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারে রীতিমতো বিপরিতমুখি।
 
একদিন তিথি আমাকে বলেছিল একা একা গোপনে বিয়ে করলে কেমন হয়? আমি বলেছিলাম ভালো হয়না। ও কষ্ট পেয়েছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম আমি কতটুকু কী পারি সে বিষয়ে। তাই কোন এক সন্ধ্যেয় আমাদের বিয়ে হয়েছিল পারিবারিক আয়োজনে। সে থেকে আমরা চলে আসি কাছাকাছি; একান্ত নিঃশ্বাসের কাছাকাছি! আমরা আমাদের সবটুকু নিজেদের মাঝে শেয়ার করলেও এখনো সেই অবস্থানেই থেকে গেছে আমাদের পূরনো পছন্দ-অপছন্দের ব্যবধান।
 
তিথির সাথে আমার ঝগড়া হয় ইদানিং সেই আগেকার মতোই। গতরাতে রিমোটের কন্ট্রোল নিয়ে ধস্তাধস্তি হয়েছে। আমার বা’হাতের বেশ খানিকটা অংশ ছিলে গেছে ওর নখের আঁচড়ে। ও নিজের হাতও নাড়াতে পারছে না ব্যথায়। সে নিয়ে ও রাতে কিছু খায়নিও। আমি অবশ্য খেয়েছি দেখিয়ে দেখিয়ে। তারপর একসময় ও ঘুমিয়ে পড়েছিল অভিমানে। আমি আইপিএল দেখেছিলাম মধ্যরাত অবধি।
 
তিথির সাথে আমার রাগারাগি ইদানিং ঘন ঘন হচ্ছে। আইপিএলে পাকিস্থানি কোন ক্রিকেটার না থাকায় ও আমাকে খেলা দেখতেই দেবেনা আর আমি নাছোড়! তবু আমরা ভালোবাসা থেকে দূরে যাইনি বলে আমি এখনো সে ধারণাতেই। এ সময়ে আমাদের বাসায় মাঝে মাঝে কারেন্ট আসে। এই তীব্র গরমে আমি যখন ঘেমে একাকার হয়ে যাই তখন মাথার পাশে একটি হাত সারারাত বিরিতিহীন হাতপাখা নাড়ে। আমাদের দুইজনের এই ফ্ল্যাট আর সংসারে আমি প্রতিদিনই ধারণা করি আমাকে অফুরন্ত শীতলতা আর ভালোবাসা জানানো এ হাত আমার একান্ত পরিচিতজনের; এ হাত অতি অবশ্যই তিথির হাত।

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।