কলম্বোর পথে-২: মেঘে মেঘে মেঘ জমে

14/07/2012 17:53

 

মাইক্রো করে হোটেল আসার পথে অনেক অনেকগুলো বৌদ্ধমূর্তি চোখে পড়লো। মূর্তিগুলো বিশালাকার। বিশালাকার মূর্তি বেশ কিছু জায়গা দুরত্বে দুরত্বে। যেখানে বিশাল মূর্তি নাই সেখানে ছোট ছোট মূর্তি। রাতের শহর বলে বৈদ্যুতিক আলোয় প্রকৃত রূপ সুধা বেরিয়ে আসে ঠিকরে। এয়ারপোর্ট থেকে আসার পথে কয়েকটি চার্চেরও দেখা মিললো। শহরের রাস্তাগুলো ছিমছাম এবং সুন্দর। লাইনের পর লাইন ধরে প্রাইভেট কার এগিয়ে চলছে। কোথাও জটলা নেই, নেই কোন জ্যাম। 
 
কলম্বো শহরকে যদি অলি-গলি আর রাস্তার শহর যদি কেউ বলে থাকে তাহলে তাকে দোষ দেয়া যাবে না। বড় রাস্তার পাশ দিকে হঠাত করেই চলে গেলে কোন এক গলি রাস্তা। আমি যাকে গলি রাস্তা বলছি তা গলি রাস্তার মতো সরু না- বেশ প্রশস্থ এবং ওয়ান ওয়ে। মোড়ে মোড়ে সিগন্যাল বাতি। আমাদের মতো অকেজো না তার কোনোটাই। সবগুলো বাতিই জলছে তার রঙ ধরে। হলুদ, সবুজ, লাল!
 
মাইক্রো চালক তার নিজের মতো করে রাস্তা ধরে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে রাস্তা বদল করছেন। কোথাও গাড়ির সংখ্যা বেশি আবার কোথাও খুবই কম। মোটামোটি রাত মানে নয়টা বাজতে শুরু করেছে ঘড়ি। রাস্তার পাশ ধরে কোন দোকান বা বাজারের দেখা নাই। মাইক্রো চালক জানালেন কলম্বো শহরে কোন হাট-বাজার নাই। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। তড়িৎ প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম তাহলে রোজকার সওদাপাতি! জানালেন, শহরের মধ্যে জায়গায়- জায়গায় বেশ ফুডসিটি রয়েছে। যেখানে সবকিছুই পাওয়া যায়। বলতে না বলতেই চোখে পড়লো বিশালাকার কারগিল ফুড সিটি তারপরেই কেলস ফুড সিটি। গাড়ি ভেতর থেকে সামান্যতম হলেও আঁচ করতে পারলাম কত বিশাল হতে পারে! পরে গিয়ে যা দেখলাম তা দেখে আমিতো অবাকই বলা যায়। রাস্তার পাশ দিয়ে মুদি দোকান, এপার্টম্যান্ট অথবা পান-সিগারেটের দোকানের দেখা নাই। আমরা সহ শ্রীলংকানরা যেহেতু একই উপমহাদেশের ভেবেছিলাম হয়তো পাওয়া যেতে পারে তার দেখা কিন্তু হায় কোথাও নাই!
 
মেইন রোড থেকে অপরাপর রোড ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। হঠাতই রাস্তার সিগন্যাল বাতি জ্বলে উঠলো। আশপাশে তাকিয়ে দেখিয়ে কোন গাড়ি নাই। তিন-চারমুখি মোড়ে এসে সিগন্যাল বাতি! দেখা গেলো একটি মাত্র গাড়ি এগিয়ে আসছে মোড় পেরুবে বলে। মাওইক্রো চালক গাড়ি থামিয়ে দিলো। অবাক হলাম কারণ এতে আমরা অভ্যস্ত নই মোটেও। যে গতিতে যাচ্ছিলাম তাতে করে রাস্তা পেরুনো যেতোই। কিন্তু মাইক্রো চালক তা করলেন না। তিনি সিগন্যাল বাতিকে উপেক্ষা করলেন না। প্রথমে ভাবলাম হতে পারে এটা তার ভুল হতে পারে। কিন্তু না যতবারই লাল বাতি জ্বলে ঠিক ততবারই গাড়ি থামে। একেবারে সিগন্যাল লাইনের মিটার দুরত্বে থাকলেও। বুঝলাম এখানকার ট্রাফিক ব্যবস্থার হাল হকিকত। 
 
অনেকখানি রাস্তা পার হয়ে আসা হয়ে গেছে। কতখানি জায়গা যেতে হতে পারে তার ধারণা পেলেও জানিনা আসলে ঠিক কতদূর! একটুখানি ব্যস্ত রাস্তায় মানুষজন রাস্তা পেরুচ্ছে। কোথাও আমাদের মতো কোন ফুট ফ্লাইওভারের দেখা নাই। মানষজনের রাস্তা পেরুনোর একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে জেব্রা ক্রসিং। যেখানে ক্রসিং সেখান দিয়েই মানুষজনের রাস্তা পেরুনোর দৃশ্য নিশ্চয়ই কোন অভ্যাসের ফল। বুঝতে বাকি রইলো না, এ শহরে কেউ রাস্তায় নামলে রাস্তা পেরনোর দায়িত্বের আসল কাজটাই করে দেয় গাড়ি চালকেরা। কারণ কেউ রাস্তা পেরুতে দেখলে গাড়ি এসে ঠিকই থেমে যাচ্ছে ক্রসিং এর পাশেই! পুরো শহরে একটা মাত্র ট্রাকের দেখা পেলাম না সামান্য সময়ের জন্যেই। মাঝে মাঝে বড় বড় বাসের দেখা পেলাম। আর বাকী গাড়িগুলোর সবগুলোই প্রাইভেট কার অথবা ত্রি হুইলার অটো রিক্সা যাকে আমরা সিএনজি অটোরিক্সা বলে থাকি। জানলাম ওখানে কোন গাড়িই গ্যাসচালিত নয়। কারণ ওদের নিজস্ব গ্যাস যে নেই! আমাদের সিএনজি অটোরিক্সার প্রায় সবগুলোই যেখানে সবুজ রঙের ওখানে ভিন্ন ভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। আমি অটোরিক্সার রঙের বাহার দেখে নিজের আশ্চর্য অনুভূতি প্রকাশ করলে পাশে বসা আমার এক কলিগ ওগুলো কবিরের সিএনজি বলে আখ্যা দিলেন। আমিসহ আমরা সবাই খুব উপভোগ করলাম ব্যাপারটা!
 
রাস্তা ধরে বৈচিত্রময় প্রকৃতি এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ দেখে এক সময়ে হোটেলে এসে পৌছালাম। হোটেলের রিসেপশনে শ্রীলংকান হাসি স্টাইলে আমাদের স্বাগত জানানো হলো। পুরো হোটেল কাঠের মধ্যে বিভিন্ন কাজ করে সাজানো। মনে হলো ইট-পাথরের পৃথিবী থেকে কিছুটা হলেও দূরে চলে এলাম। রিসেপশনে জিজ্ঞেস করলাম গাড়ি ভাড়া কত? জানানো হলো পঞ্চাশ ডলার! মোটামোটি টাসকি খেলাম। মাত্র এতটুকু পথ তা আবার পঞ্চাশ ডলার! ঢাকায় হলে এর ভাড়া বড়জোর হাজার-পনেরশত! কিছু বললাম না। পকেট থেকে বের করে দিলাম। প্রথম ধাক্কাতেই বুঝলাম অনেক এক্সপেনসিভ এক শহরে এসে পা রাখা হয়ে গেলো! 
৩।
ডিনার সেরে দেখি পকেটে লাইটার নেই। সিগারেটে আসক্তি আছে অনেক দিন। কিন্তু লাইটার না থাকায় খুব অসহায় বোধ করতে লাগলাম। শাহজালাল এয়ারপোর্ট থেকে ডিউটি ফ্রি শপ থেকে এক কার্টন বেনসন এনগ হেজেস কিনে আনা ছিলো। আমার আর আমার আর এক কলিগের কাছে অনেক অনেক সিগারেট কিন্তু সামান্য এক লাইটার নাই। হায়, এমন করে বোধ হয় মানুষ এমন অবস্থায় পড়ে। মনে মনে হিসাব করতে লাগলাম সর্বশেষ সিগারেট নেয়া হয়েছিলো সকাল ১১টার দিকে তখন বাজে রাত ১০! মনে হয় পারা যায় সিগারেট না খেয়েও!
 
মনে পড়লো একদিনের শোনা কৌতুক। স্বর্গে যাবার আগে দেবদূত জিজ্ঞেস করলেন কে কী চায়। আমেরিকান চাইলো এক নারী, ভারতীয় চাইলো রবীন্দ্র সমগ্র আর বাঙালী চাইলো সিগারেট যাতে করে নির্ধারিত একশত বছর থাকা যায়! এক সময় একশত বছর পার হয়ে গেলো। স্বর্গের দেবদুত এসে তাদের আটকে থাকা দরোজা খুলে নিলেন। আমেরিকান ভদ্রলোক ঘরভর্তি ছেলে-মেয়ে নিয়ে বের হয়ে এলেন। ভারতীয় ভদ্রলোক দাড়িগোঁফ রাখাবস্থায় কবিতা আবৃত্তি করতে করতে বেরিয়ে এলেন। স্বর্গীয় দেবদূত যখন বাঙালী ভদ্রলোকের দরোজা খুলে দিলেন। ঠিক তখনই অগ্নিমূর্তি হয়ে বেরিয়ে এলেন বাঙালী ভদ্রলোক। গর্জে উঠে বললেন একশত বছরের সিগারেট দিয়ে দিলে কিন্তু লাইটার কোথায়! হা হা হা! এমনই অবস্থা হয়ে আছে মনে হয়!
 
কলম্বো শহর আসলে এমনই। আপনার পকেটে সিগারেট আছে কিন্তু কোন অবস্থায়ই আপনি তা ইচ্ছেমত খেতে পারবেন না। শ্রীলংকায় পাবলিক প্লেসে ধুমপান নিষিদ্ধ এবং জরিমানার বিধান রয়েছে। এ বিধান আমাদের দেশেও রয়েছে কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম আমাদের দেশে যেখানে সবাই যেখানে-সেখানে ইচ্ছেমত ধুমপান করতে পারে এখানে তা সম্ভব নয়। রাস্তাঘাটে কোথাও সিগারেটের টং ঘর অথবা দোকান পাওয়াতো দূরের কথা কোথায় কোন দোকানে সিগারেট রয়েছে তা খুঁজে বের করাটা সত্যিকার অর্থে কঠিনই। আর কোথাও সিগারেট পাওয়া গেলে খোলা লাইটার পাওয়াটা আরো কঠিন।
 
অন্য যে কোন জায়গার তুলনায় শ্রীলংকাতে সিগারেটের দামও বেশি। একটা বেনসনের দাম ওখানে ২১ রুপি। একটা দিয়াশলাইয়ের দাম ৪ রুপি। সে তুলনায় ওখানে বিয়ারের দাম খুব কম। শহরের যেখানে সেখানে বিয়ার-লিকারের দোকান যেভাবে আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে তা বাংলাদেশে অসম্ভবই। অথচ কোথাও আপনি প্রকাশ্যে ধুমপান করা লোক খুঁজে পাবেন না এমনকি কোন দোকান খুঁজে পেতে প্রাণ যায় যায় হয়ে কিন্তু পাবেন কী না ঢের সন্দেহ! মানুষের মধ্যে এই সচেতনতার মুল কারণ হলো বিভিন্ন মিডিয়ায় ধুমপানের ক্ষতিকারক দিক নিয়ে প্রামাণ্য অনুষ্ঠান এবং সেদেশের প্রেসিডেন্টের ধুমপানের বিরুদ্ধে উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন আমাদের এক কলিগ। শ্রীলংকায় বিয়ারসহ অন্যান্য লিকার যেখানে সহজলভ্য সেখানে সে দেশের প্রেসিডেন্টের এমন ভূমিকা আসলেই ভালো লাগার উপলক্ষ্য এনে দেয়।
 
সেদিন কথাপ্রসঙ্গে আমাদের একজন কলিগ জানতে চাইলো প্রতিদিন কয়টা সিগারেট খাই। আমিসহ আমার আর এক কলিগ সংখ্যাটা বললে সে আঁতকে উঠে। আমি অবাক হই। তরলের সহজলভ্যতাযোগ এক দেশের উঠতি প্রজন্মের ঘুমপানের প্রতি এমন অনীহা খানিকটা অবাক করে দেয়। আমার এ অবাক হওয়াটা আসলে ইতিবাচকই!
 
আমাদের টিমের চারজনের দুইজন আমরা ধূমপায়ী। বাকি দুইজনের দলে আমিও নাম লিখাতে চাইছি ইদানিং। এর মুল কারণ লজ্জ্বাবোধ। এখানে ধুমপান করতে গেলে নিজেকে খুব আজব কিসিমের মানুষ মনে হয়। মনে হয় সবাই কেমন যেন অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে। পরিবেশ দূষিত করছি বলে কেউ কেউ আমাকে করুণাও করছে! আমি ঠিক করেছি ছেড়ে দেব ধুমপান! এর জন্যে প্রাথমিক কাজও শুরু করে দিয়েছি। এ ছাড়া আসলে ছাড়ার জন্যে ছাড়া না, নিজেকে বাচানোর জন্যে।
 
আমি আমাকে বাঁচাতে গিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি ধূমপান। এ সংবাদ আমি প্রচারও করছি খুব করে। আমার এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে আসলে কলম্বো এসে। এখানে এসে আমি অনুধাবন করতে পারি ধূমপান আসলে একটি পাপ। এ পাপের মুল কারণ পরিবেশ দূষণ। একদিন আমাকে কেউ না কেউ দোষী সাজাতে যাবেই, যাবে! এ আমি দোষী হতে যাবো কেন! সিগারেট ছাড়ছি এ সংবাদ সেদিন জানালাম এক কলিগকে। ও খুশী হলো খুব করে। খুশির চোটে উল্লাসধ্বনি করলে সে নিজের ভাষায়- শাহ্‌!
 
Back

Search site

একটি ব্যক্তিগত ব্লগ। সব দায় এবং দায়িত্ব লেখকের একান্ত নিজস্ব।